Monday 30 November 2015

মধ্যরাত

মধ্যরাতে টঙ দোকানগুলো অদ্ভুত নীরবতার সাক্ষী হয়। হেমন্তের রাত, কুয়াশা এসে ভর করে, ভ্রাম্যমাণ দোকান স্থির দাঁড়িয়ে, চামুচ আর কাপের টুংটাং নেই। কুয়াশা ভিজিয়ে দিয়ে যায় রাজপথ। কিছু বিনোদিনী দাঁড়িয়ে রাস্তার ও'পাশে, কড়া লিপস্টিক, চুলে তেল দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় ব্রত। তাদের রাত মানেই অনেকের দিন। সামান্য কিছু মানুষের রাত মানেই বাঁধন হারিয়ে অশ্লীল জোয়ারে ভেসে যাওয়া।

পথের অন্বেষণে অনেক ধুলো জমে আছে। পায়ের জুতো জোড়া ছিঁড়েছে যত না ক্লান্তিতে তার চেয়ে বহুগুণ অবহেলায়। কিছু মানুষের কোথাও যাওয়ার থাকে না। তারা দিন শেষে ফিরে আসে, কাঙ্ক্ষিত জায়গাতেই। সেই একটা কক্ষপথ মেনে ছোটাছুটি। সফেদ পাঞ্জাবি, ময়লা খুবলে খাচ্ছে শরীর। তবুও এক কাপ চায়ের তৃষ্ণাটুকু জানান দেয়, বেঁচে থাকতে হলে অনেকবার মরে যেতে হয়।

টিকে থাকে বেঁচে থাকার করুণ আর্তনাদ। আমি ঈশ্বরীকে ছুঁড়ে দিই রেড রোজ। ছুঁড়ে দিই চার শব্দের চিরকুট। তরুণ চোখের স্বপ্নগুলো ল্যান্ডস্কেপ ক্যানভাসে আটকে যায় অকারণে। আমার ভিতরে ক্রমান্বয়ে টের পাই ভিন্ন কোনো এক সত্ত্বার। তাকিয়ে দেখি আমি আমাকেই দেখছি আমার সামনে।

স্পর্শের ক্যানভাস

অন্য কোনো প্রাপ্তি সংবাদ নেই। থেমে যেতে যেতেই হারিয়ে যাই। বিজ্ঞাপনের পাতাজুড়ে বাণিজ্যিক আবেদন। শূন্যতাকে নিয়ে লেখা বিষণ্ণতার পরিক্রমা। বিশাল বৃক্ষরাজির পরেও শ্বাস নিতে প্রয়োজন খালি স্থান। একটু দম নিয়ে জিরিয়ে নিই তাতে। তারপর আমার খোঁজ করি নতুন তীর্থের।

এভাবেও হয়ে ওঠে না। খালি হাত স্পর্শহীন থাকে আজীবন। শুধু অনুমান করে যায় ছোঁয়াটুকু। আর অবসরে সেই স্পর্শের ক্যানভাস আঁকতে বসে। সাদা ক্যানভাস ভরে যায় এলেবেলে কালির দাগে। যেভাবে আঁকতে চাওয়া, ঠিক কোনটাই আর হয়ে ওঠে না। অ্যাবস্ট্রেক্ট আর্ট বলে টিটকারি শোনা যায় আশেপাশে।

ইট পাথরের সভ্যতা জানে, বেঁচে থাকার কোনো রসায়ন নেই। লোকালয়ের এতো ভিড়ের মাঝে ক'জনেই বা বাঁচতে শিখেছে। তবুও শ্যাওলা জমা দেয়ালে কারা যেনো লিখে যায় একগুচ্ছ নীতিবাক্য। প্রাতঃভ্রমণে সেগুলো পড়ি, আমি ছাড়া আর কেউ নেই পড়ার। হয়তো কাজহীন বলেই দৈনন্দিন পাঠ্যভ্যাস। পড়ার পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়ী ফিরি।

পত্রিকার পাতায় নিখোঁজ বিজ্ঞাপনগুলো দেখি। দরকারি অনেক জিনিষের মাঝে অদরকারি স্বপ্নটিও হারিয়ে গেছে অবহেলায়। তাকে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। হয়তো বা পৃথিবীর সকল কষ্টের বোঝা নিয়ে বসে আছি আমি একা, এখানে।

অন্ধকারাচ্ছন্ন

পৃথিবীজুড়ে এক অদ্ভুত অন্ধকার। আলো আছে, আলো নেই – মরীচিকা জীবন। রক্তে ভেসে যায় পতাকা, জন্মের শুরুতেই অপরিচিত একগুচ্ছ মেঘের ভাজে হারিয়ে গেছে সোনালি মথ। ভয়ের যাত্রাপথ, টিকে থাকে অপ্রয়োজনীয় শব্দ কোলাহল যারা ধ্বংস করতেই শিখেছে।

শিকড়ে যাও, আরো অনেক গভীরে। প্রশ্ন করতে শিখো নিজেকে। কার জন্য এই পথযাত্রা। কেনো এগিয়ে গেছো মানচিত্র ভুলে। শান্তির বিনিময়ে কিসের আভাস। ব্যাকরণের পাতায় ভুল সংজ্ঞা। হারিয়ে যাওয়া মেঘ জানে রক্তের জন্ম। বিষাক্ত আকাশে জুড়ে মোমবাতি জ্বালাই। আলোকিত হোক তবুও আমার আঙিনা।

ঘুম ভেঙেই দেখি অন্য এক সকাল। অন্ধকারের চেয়েও সে গাঢ়। চুপ থাকলেই এড়িয়ে যাওয়া যায় সবকিছু। এভাবেই চুপ থেকে একে একে পুড়ে যাচ্ছে দেশ। মধ্য পৃথিবী জুড়ে আঘাত হেনেছে বিলাসী জীবন। এরপর চাপিয়ে দিয়ে কেড়ে নাও বক্ষদেশ।

কারা যেন যুদ্ধের জন্ম দিয়ে কোথায় পালিয়ে গেছে। সংযমের সংজ্ঞা ভুলে গেছি অকারণে। ভুলে যাওয়া কোনো বাগানে, প্রলয় সুরে উড়ে গেছে, থামার আগেই ডাকছে আমাদের কেউ।

Sunday 29 November 2015

ভয়

দুটো মানুষের এভারেস্ট জয়ের আনন্দ
পাতা জুড়ে একটি পরিবারের হৈ হুল্লোড়


মসজিদে মিলাদ আর পাড়া জুড়ে মিষ্টমুখ।

প্রিয় মানুষের প্রত্যাশার ধন বলেই তার
নাম রেখেছিলো প্রত্যাশা-ই
ছোট মানুষের ছোট ছোট পোশাক,
গ্রাম থেকে চলে আসা আত্মীয় স্বজন
দিনভর জ্বালিয়ে রাখা হারিকেন, আগুনে
শয়তান আসে না এই অবৈজ্ঞানিক সূত্র।
ঘর মাতিয়ে রাখা আকাঙ্ক্ষিত মুখটি
নিয়ে আনন্দে কেটে যায় প্রতিটি চরিত্র।


প্রতিবেশী আসেন আসে অন্যসব লোক

পরিবারের প্রধানের হাসিখুশি মুখটি
জানান দেয় শক্ত চোয়াল আটকে রাখে
আনন্দের ফোয়ারা। গৃহকর্ত্রীও স্বপ্নের
মাত্রা বাড়ান, যোগ করেন, অত:পর গুণ...
দিন শেষে ক্লান্তি মোছেন আঁচলে।
তার সব পরিকল্পনা সাজান আনন্দের
বিষয়টুকুকে প্রাধান্য দিয়ে।
ঘরে বাড়তে থাকে খেলনাপাতি, পুতুল
একদিন বসতে শিখে প্রত্যাশা,
আধোআধো বোল, প্রাপ্তির হিশেবে


কাঁধে ইশকুল ব্যাগ! তারও আগে

রয়ে যায় বর্ণ চেনার আয়োজন
অংক শেখার পর, চক ডাস্টারের
কাঠের দরজার বুকে নানা ক্যালিগ্রাফিতে
বাংলা বর্ণ লেখার আঁকিবুঁকি।
বিকাল গড়ালেই বাড়ীর সামনে ছোট্ট
উঠানে দৌড় ঝাপেই প্রাণান্ত সময় পার।


ইশকুল মানেই এক অজানা ভয়

শিক্ষকদের বড় বেতের মাঝে জুটে
যায় অনেক অনেক বন্ধু স্বজন।
এই সময়ের বন্ধু গুলো অন্যরকম
আইসক্রিম খায় আবার খাওয়ায়
টিফিন ভাগ করে খেতে দেয়
নানা রঙের স্টিকার কিনে খাতায়
লাগিয়ে রেখে দেয়, পিটির সময়
সবার পিছনে দাঁড়িয়ে দুষ্টুমি করে...
তবুও ইশকুল ভালো লাগে না।


মাঝ পিরিয়ডে পালিয়ে যাওয়ার ভুত

তখনো চেপে ধরে নি, তবুও শিখে
গেছে পিটি পালানোর সবগুলো মাধ্যম।
টয়লেটে, বেঞ্চের নিচে গোপন কোনো
উপায়ে ঠিকই পালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা,
আবার কখনো সখনো ধরা পড়লেই
জোড়া বেতের আঘাতে লাল হতো পিঠ।


একটু বড়ো ক্লাস মানেই বুড়ো হবার বাসনা

ভাব নিয়ে সামনে চলা, নিচের ক্লাসের
ছাত্রদের বাচ্চা মনে করা, অথচ এখনো
প্রাইমারি ইশকুলের গণ্ডিটা পার হয় নি।


হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট ধরা শিখলো।

সকাল সাতটার ইশকুল এখন দশটায়
সকালে আরাম করে ঘুমানো যাবে,
কেউ নেই বকার। তবু সাতটায় ঘুম ভাঙে
মায়ের বকুনি তে বিছানা ছেড়ে উঠে।
অত:পর চা নাশতা সেরে, পাঠ্য বইয়ের
ফাঁকে কমিকস। বাবা মা'র কড়া নজরদারি।
এসবের ফাঁকে দেখা যায় কৈশোর জীবন।


ইশকুল ফাঁকি দিয়ে খেলার মাঠ, ক্রিকেট

খেলা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়।
টাকার চ্যালেঞ্জ, টাকা কামাইয়ের ছোট্ট
পন্থা, প্রধান শিক্ষকের জোড়া বেত হাতে
ইশকুলের এক প্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তে
দৌড়ানো তাকে খুঁজে বেড়ানোর তাড়া।
পরীক্ষায় অংকে আর ইংরেজিতে ফেল
বাসায় নালিশ, বাবার মার, মা'র ভেজা চোখ।


এলাকা মাথায় তুলে রাখা দুষ্টামিতে।

এর মাঝে কৈশোরের মধ্য বয়স, প্রেম
বুঝেও বুঝে উঠে নি, অথচ ভালোলাগা
কড়া নেড়ে যায় প্রতি বিকালে। খেলার মাঠে
বাড়ীর ছাদে, শ্রেণি কক্ষে সবসময় কারো
উপস্থিতি খোঁজে চলে অকারণ অজুহাতে।
একদিন ঘুড়ি শিখলো নাটাইয়ের সাথে
সুতোর বাঁধন ছিঁড়লে বেরিয়ে আসে আবেগ।


অংক, ইংরেজি তে ফেল করা ছেলেটিও

কিভাবে যেন পেরিয়ে যায় ইশকুল জীবন
সব বিষয়ে পাস, পাড়ায় আবার মিষ্টি
বিতরণ, মসজিদে মিলাদ আর দোয়া পাঠ
বাবার গর্বে বুক ভরে যায়, মায়ের আদর
বাড়তে থাকে।


ডাকছে কলেজ জীবন! লাল নীল ঘুড়ি,

বন্ধুরা মিলে চায়ের দোকানে আড্ডা,
হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখা চারপাশ
রাজনীতির হাতে খড়ি পাঠের শুরু হঠাৎ
কিভাবে যেনো জড়িয়ে গেলো এই পথে
ফেরানো যায় নি আর কোনো উপায়ে।


কদিন বাদে কলেজে সমস্যা, বাড়লো গ্রুপিং

নিজেদের মাঝে শুরু হলো মারামারি।
উচ্ছল ছেলেটি গুটিয়ে নিলো নিজেকে
হাসি ঠাট্টা থেমে গেলো তার,
সারাক্ষণ কে যেন তাড়া করছে তাকে
মৃত্যু ভয় নেই, তবুও এক অজানা আশংকা।
পত্রিকার পাতায় ইদানীং তার নাম আসে
পুলিশের খাতায় নাম উঠেছে অনেক আগেই।


রাজনৈতিক সভা তে, মিছিলে অগ্রভাগে

দেখা যাওয়া লোকের ভিড়ে, তার পিছনে
অনেক লোক আজও দাঁড়িয়ে,তাদের
কেউ সুযোগ সন্ধানী, বাকিরা আততায়ী।


একদিন ব্যাপক হট্টগোলে কলেজ বন্ধ

দেশীয় অস্ত্রের দামামা বাজলো দু'পক্ষে
কলেজ বন্ধ, অনির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত।
পরের দিন সকালে দৈনিক পত্রিকায়
প্রথম পাতায় লাল কালিতে বিশাল হরফে
মৃত্যুর খবর। ধারাবাহিক প্রতিবেদনে
উঠে আসে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্যাদি।


তার মৃত্যুর পরে, শোকসভা...মানব বন্ধন...

এলাকায় গড়ে উঠেছে স্মৃতি সংসদ
দেয়ালে ঝুলছে "হত্যার বিচার চাই"
নেতা আসেন, সান্ত্বনা দেন,
মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ভাসে তার মুখে।


এভাবে পেরিয়ে যায় কয়েক বছর

আর এই সময়ে রুটিনমাফিক চলছে মৃত্যু
দিবসে বক্তৃতাবাজি সভা, কাঙ্গালি ভোজ
আয়োজনে থাকে রাজনৈতিক নাম,
নেতা আসেন, মৃত্যুর দাবী জানান,
আইনের মারপ্যাঁচে বিচার কাজ শেষ হয় না।
সব কিছুই হয় শুধু চলে যাওয়া মানুষটি
আর ফিরে আসে না।


ইদানীং আরো একটা ছেলে দেখি। ঠিক

তার মতো, একই রকম হাঁটা, চলা, বসা
আড্ডায় মাতিয়ে রাখে চারপাশ,
ঠিক যেনো সেই ছেলেটির প্রতিবিম্ব।


তাকে দেখলেই আমার ভয় হয়,

অজানা আশংকা জাগে,
আবার কখন কোনো প্রাণবন্ত প্রাণের
চলে যাওয়ার করুণ সুর শোনা যায়


এই ভয়ে...দরজার খিড়কি আটকে রাখি...