Wednesday 31 August 2016

নাবিক চোখ

নাবিক চোখ
 — ইমেল নাঈম

থামতে থামতে একটা পালক রেখে দাও
মায়াজাল ছিঁড়ে ফেলেছি অনেককাল
ভ্রান্ত জীবনের হাঁসফাঁস, ডেকে তোলে
শামুক জীবনের ইতিবৃত্ত,

এক মুঠো শস্যদানা, মুঠোয় ধরে রাখো
বাঁধা নেই, পাবার ইচ্ছেও হারিয়ে ফেলেছি
চেপে রেখেছো দাঁত, আঘাতে জর্জরিত
কয়েক জীবনের ঘুমন্ত শরৎকাল।

শঙ্খ কোথাও হয়তো বাজে, থেমে যায়
জীবনের নিনাদ... ঐকতানে জোয়ারভাটা
খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ছে শিশু।
আকাশ আঁকতে বসে উদাসী এক কবি
এঁকে নিলো বিরহী পোট্রেট,

মেঘ ধরে রেখে ঝুম বৃষ্টি নামে,ভেসে আসে
অন্যরকম শরতাকাশ, উদ্বেলে নাচতে
শেখা ময়ূরটিও চুপচাপ শান্ত হয়...
আমি খুঁজি জীবনের পোট্রেট, যেখানে
ভুল সব চিত্রপটের ভিড়ে হারিয়ে গেছো...

ভাসমান আবছা দাগগুলোকে তুমি
ভেবে বারবার ভুল করি, আয়না দেখলে
বুঝতে পারি অকালে বৃদ্ধ নাবিক চোখকে — 
শুধুই আমাকে দেখে করুণ দৃষ্টি দিয়ে।

Monday 29 August 2016

মুখোশের বিজ্ঞাপন

মুখোশের বিজ্ঞাপন
— ইমেল নাঈম

মুখোশের বিজ্ঞাপনে হারিয়ে ফেলেছো মুখ
আয়নাকে করেছো এতোটাই প্রশিক্ষিত
প্রতিবিম্বে ভাসছে সফল এক মূকাভিনেতা।

রাতের আলো নিভলে নিজেকেই চিনিনা
লোভনীয় প্রস্তাবের ঘুটি চালান দিলে
মুখোশের সংখ্যা বেড়ে যায় — আটকে যায়
ইঁদুর দৌড়ে বারবার জানান দিতে গিয়ে।

কড়া পানীয়জলের অট্টহাসি ঢাকে পূর্ণিমা
সন্দেহের বাতাবরণে বখে যায় অষ্টাদশী রাত
প্রহসনে কাঁদে যে স্বপ্ন তাকে মাতাল করো
নেশার স্তূপে, ডুবিয়ে দাও চিরতরে —

ছুটে চলে ফোর হুইলার। মুখোশের বিজ্ঞাপন
শুধু মুখোশই খোঁজে। রাতের আলেয়ায়
নিজেকে নগ্ন করা যায়, সামাজিক বেশ্যারা
সব দেখে কালো লোভনীয় চশমা পরে
এভাবে মিলে যায় চাকচিক্য জীবনের স্বাদ।

রাত বাড়লেই সকাল, অসামাজিক মুখোশ
সামাজিক হয়, কেউ জানেনা গল্পগুচ্ছ।
এসবের ভিড়ে প্রতিরাতে এক মাতাল
হেড়ে গলায়  মা মাসি তুলে গাল দিচ্ছে
তাকে কেউ থামাও, নিস্তেজ হোক কণ্ঠস্বর...

Sunday 28 August 2016

সূর্যকুসুম মাসুমের কাব্যপ্রতিভার ভূমিকা মাত্র - ইমেল নাঈম

পরাবাস্তব আর উত্তরাধুনিক কবিতার ভিড়ে পাঠক যখন এক অচেনা গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছেন অনবরত, কবিতার অতলে ডুবে যাচ্ছেন অথচ জানেন না কোথায় ছুটে যাচ্ছেন, বুঝতে পারছেন শেষ দরকার, অথচ বুঝতে পারছেন না এর শেষ কোথায়, দিন শেষে অভিযোগ আর অনুযোগে ভাসিয়ে দিয়ে বলছেন "কবিতা বুঝি না"। পুরো লেখাটা আত্মস্থ করতেই পারছেন না, বারবার বলছেন মাথার উপর দিয়া গেলো লেখাটা.... সত্যি কথা বলতে আমি নিজেও ভয় পাই, এমন কবিতাগুলোকে।

গ্রামের সোঁদা গন্ধ, মফঃস্বলি বাঁক, নাগরিক জীবনের টানাপোড়ন এইসব নিয়েই দীর্ঘপথ এগিয়েছে কবিতা, কবিতায় যোগ হয়েছে নিজস্ব দর্শন, এরবাইরে যোগ হয়েছে বিজ্ঞান, রাজনীতি, ভাষাতত্ত্বের মতো মজাদার বিষয়। কবিতা পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য নয়, আনন্দদায়ক করে তোলার কাজটা সত্যি কঠিন কিছু নয়, খেয়াল রাখতে হয় অপ্রয়োজনীয় গিমিক বা চমকে দেয়ার প্রবণতা আর রূপকের ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করলে। মাসুম মুনাওয়ারের প্রথম বই সূর্যকুসুম বইটা তার স্বার্থক নাম না হলেও মাসুমের প্রয়াস সত্যি প্রশংসা কাড়ার মতো।

First sight at Love - বাক্যটি নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। নানা মতের সমাবেশ হতে পারে দশদিক হতে। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে এই বাক্যটি অন্যান্য যে কোনো বাক্যের চেয়ে বেশি জোরালো ও শক্তিশালী মনে হয়। সূর্যকুসুম যখন হাতে আসে তখন রোজার ঈদের ছুটি আর দেশের সামগ্রিক অবস্থায় মনটা অনেক বিক্ষিপ্ত ছিলো। বইটায় হাতে নিতেই চোখ পড়লো চারু দা মানে আমাদের চারু পিন্টুর মনোরম প্রচ্ছদ। বুঝতে পারলাম প্রথম দর্শন আর প্রেমের মাহাত্ম্য। ৪ ফর্মার বই, কবিতা সংখ্যা ৫২ টি। প্রতিটি কবিতায় গ্রামীণ দৃশ্যপট, দেশ, রাজনৈতিক ক্ষোভ, প্রেম বিরহ, নানা রকম অন্যায় অবিচার উঠে এসেছে অবলীলায়। পুরো বইটি জুড়ে সরলতার পাঠ, কোনো দুর্বোধ্যতা নেই। শব্দ বিন্যাসগুলো সহজ কিন্তু সাবলীল। সাধারণ পাঠকের জন্য একটা ঘোর তৈরি করার মতো উপাদান অন্তর্নিহিত আছে, আর পাঠক যদি হোন বিচক্ষণ, তবে তার জন্য রয়েছে ভাবনার ট্যুইস্ট।

আলোচনা শুরুর আগে একটা চমক অপেক্ষা করছিলো বইটা খুলেই বুঝতে পারছিলাম। কিছু কবিতার নামকরণ সত্যি চমকে দেয়ার মতো, একটি বর্ণমালায় একটি কবিতার শিরোনাম। প্রথম কবিতার নাম অ, পরেরটির নাম আ। সাধারণত কবিতার বই আমি শেষ পাতা হতে পড়ি। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হলো না। নিঃসঙ্গ বাদর পড়তে গিয়ে পেলাম,
      "অ- কথা বলে না
       নি- কথা বলে না
       রা- কথা বলে না
       কোন নারীই কথা বলে না।"
ভাবছিলাম অ, নি, রা (অনিরা ভেবেছিলাম একবার) এই ছোটোছোটো নামগুলো সেই কৈশোরকালীন চিরকুট প্রেমের কাছে নিয়ে গেলো। অ দিয়ে প্রেমিকার আদ্যাক্ষর। বা এমন কোনো সংকেত যা অন্যদশের কাছে অজানা। ভাবনার মোহ থেকে বেরিয়ে আসতেই নিঃসঙ্গতার বিজ্ঞাপন। শেষ পঙক্তিতে এসে বললেন জলস্রোতের কথা, শহর ডুবে যায় না পাওয়া ব্যর্থতায়, কিন্তু প্রেম... না পাওয়ার মাঝেও তা ভাস্বর।

বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক কবিতাকে একসময় অনগ্রসর শাখা হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। যদিও ভার্চুয়াল যুগের কল্যাণে বর্তমানে কবিতায় আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। সেটা প্রয়োগের দিক থেকে নিপুণতার প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে অনেক মুখ। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয় আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখা কঠিন। একটা অঞ্চলের ভাষার উপর পরিপূর্ণ জ্ঞান, অদ্য অঞ্চলের মানুষের কথা বলার ধরণটুকু আয়ত্ত করলেই হয় না, অন্যান্য জেলার মানুষের জন্য কবিতাটা কতটুকু প্রাঞ্জল আর বোধগম্য হয়ে উঠছে কিনা তাও কবিকে খেয়াল রাখতে হয়, এরজন্য কবিতার যে সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যাবলীর ব্যত্যয় না ঘটে তার জন্য তাকে হতে হয় অনমনীয়। কবিতায় সবুজকে তুলে আনা, স্যাটায়ারের মাধ্যমে আঞ্চলিকতার রেশ টেনে সবুজ বাঁচানোর যেই আন্দোলন বর্তমানে চোখে পরে তাই যেন মাসুমের কবিতায় উঠে এসেছে সাবলীলভাবে।
       "চান্দিনা রাইতে যতদূর দেখা যায় শুধু শেয়াল আর শেয়াল
        শতে শতে শেয়াল, হাজারে হাজারে শেয়াল
        পণ্ডিতগণ একসাথে ডাইকা ওঠে --
        জংলা রক্ষার দাবী-- আঠারো হাজার মাখলুকাত রক্ষার দাবী"

নেত্রকোনার ভাষাতেই কবি তুলে ধরেছেন শেয়ালের বন রক্ষার সমাবেশ -- যা অনেকটা আমাদের মানব সমাজের কোনো একটা দৃশ্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আঞ্চলিক কবিতা পড়ার সময় একটা ভয়ও কাজ করে, বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে খিচুড়িভাষায় কবিতা সংখ্যা হচ্ছে, অনেক সময় কবি সেগুলো না বুঝেই লিখছেন - যা পাঠক কানের জন্য সত্যি পীড়াদায়ক। মাসুমও তার কবিতায় সেই পথে হাঁটেন নি, আবার হেঁটেছেনও।

হাঁটার পথ চলে যখন চলে এলো তখন এটা স্পষ্ট করেই বলতে হয় কবিতার পথের শেষ নেই। চিত্রনাট্যের ভাজে ভাজে ছড়িয়ে থাকে নানারকম বাঁক, থাকে ঘাত ও প্রতিঘাত -- যা পাঠককে নিয়ে যায় এক অধ্যায় থেকে অন্য এক অধ্যায়ে। এক কবিতায় পাঠক পরিভ্রমণ করেন এক জায়গা থেকে অন্যকোনো জায়গায়। মাসুম তার কবিতায় দৃশ্যপট অংকনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। পাঠকের পাঠের পর একটা অদ্ভুত ভালোলাগা থাকে। অত্যাধুনিকতার মোড়কে মোটেও দুর্বোধ্যতার পথে যান নি। তিনি সরল মনে বলে গেলেন নিজের কথাগুলোকে। তেমনই একটি কবিতার গুটিকয় কিছু লাইন--
        "দিশেহারা পথিক,
         চেয়ে থাকে অপলক শূন্যে, মহাশূন্যে
         অতঃপর চোখের কোণে একফোঁটা জল
         এবং লাল মরীচিকা বাস।"
একটি না পাওয়ার বিজ্ঞাপন, মোহের বশে দৌড়ে চলা প্রতি মুহূর্ত। উড়ে বেড়ানো সময়ে ক্লান্ত হয়ে হাত পা ছোঁড়া আক্ষেপের আবেশে পুড়তে পুড়তে বুঝতে শেখা অসহায়ত্বের মায়াজাল। মাসুমের কবিতায় আমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক মনে হলো তার সহজবোধ্যতা আর গতিময় পঙক্তিমালা সেই সাথে কবিতার আবেগের ব্যবহার (যদিও এনিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা আছে) যা পাঠক এক মুহূর্তে দেয় এক অবিরাম ফল্গুপ্রবাহ।

বাঙালি স্যাটায়ার বোঝে না -- এই কথাটার সাথে আমি পুরোপুরি একমত। মুখবইয়ের দুনিয়ায় এমন ভুল বোঝাবুঝির অনেক নজির পাওয়া যাবে। স্যাটায়ারের প্রসঙ্গ নিয়ে বললাম "প্রতিবেশির অধিকার চাই" কবিতাটি পড়তে গিয়ে --
       "সীমান্তে অবাধ খুনের বৈধতা চাই
         চাই প্রতিবেশি আমাকে দেখভাল করুক
         আমার আকাশে প্রতিবেশির ঘুড়ি ওড়ানোর স্থান চাই
         এ-অধিকার মৌলিক, এই অধিকার মানতেই হবে।
        আমার পাহারাদার কুকুরগুলোকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিতেই হবে
         হাজার গুলিতে ঝাঁঝরা হলেও যেন রাইফেল অবনত রাখে
         মৃত্যুর আগেও যেন শেষ স্যালুট হয় প্রতিবেশির প্রতি"
মাসুমের অভ্যন্তরে জমে থাকা ক্ষোভকে নিংড়ে দিলেন, প্রতিবেশি কর্তৃক অন্যায় কে সরাসরি নয়, ঘুরিয়ে বললেন, তা বলতে কূটনৈতিক ভাষার আশ্রয় নেন নি, সাদামাটা ভাষাতেই বললেন তার যত অভিমানগুলোকে। বললেন পাহাড়াদার কুকুরদের প্রশিক্ষণ দিতে যাতে তাদের অস্ত্র সবসময়ের জন্য নিচু থাকে। প্রতিবেশির অধিকার চাইয়ের নামে একটা বিশেষ মহলের দিকে আঙুল তুলে দিয়ে বললেন নিজের অধিকারটুকু ছেড়ে দেয়ার কথা। তুলে ধরেছেন নিজেদের অসাবধানতায় বঞ্চিত হবার ইতিবৃত্ত। ভিতরের চূড়ান্ত ক্ষোভ কে উগড়ে দিয়েছেন মাসুম তার এমন কিছু কবিতায়। দেশ নিয়ে মাসুমের চিন্তাভাবনা সত্যি আশান্বিত করে তোলে আমাকে।

আবেগ নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। কবিতা মানেই শুধুমাত্র আবেগ নয়, অনেকসময় কবিকে আবেগের লাগাম টানতে হয় পাঠক কে কবিতার মাঝে একটা গন্তব্যে নিয়ে যাবার জন্য। আবেগের অতিরিক্ত ব্যবহার পাঠককে কবিতা থেকে ডিসকানেক্ট করে দেয়। মাসুমের কিছু কিছু কবিতায় আবেগের প্রবল ব্যবহার চোখে পড়লো, মনে হলো কবিতা কবির হাত থেকে ফস্কে বেরিয়ে এখন লাগামহীন হয়ে ছুটে যাচ্ছে সামনের দিকে। এইদিকটায় মাসুমকে আরো অনেক সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে কবিতাগুলোর পিছনে আরো বেশি সময় দিতে হবে। কবিতায় অতিরিক্ত আবেগের ব্যবহার দেখেই মনে হচ্ছিল কবি এখানে ভুলে গেছেন অপ্রয়োজনীয় শব্দ বিন্যাস কবিতাকে নড়বড়ে করে তোলে আর পাঠককে করে দেয় বিচ্ছিন্ন।

ছোটো কবিতার যে সাম্প্রতিক ট্রেন্ড তাকে মোটেও অস্বীকার করেন নি মাসুম মুনাওয়ার। তার বইতেও তিনি অনেক ছোটো কবিতা স্থান দিয়েছেন। তেমনই একটি ছোটো কবিতা 'ঋ'। চলুন ঋ কবিতাটা পড়ি।
     "রাত গভীর হলে স্বপ্ন ঘাড়ে চেপে বসে
      অতঃপর ঘামে ভেজা চাদরে হাত মোছে সকাল।"
দুটো লাইনের কবিতা, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় কিছুই নেই। কিন্তু কবিতার গভীরে যাদের চোখ, তারা ঠিকই বুঝে নিতে পারে এর কাব্যিক নির্যাস। তবে এমন কিছু ভালো কবিতার পাশাপাশি আরো কিছু কবিতা পড়ে মনে হলো কবিতাগুলো আরো শব্দ ডিম্যান্ড করে। চিত্রপট থাকে অথচ গভীরতা নেই। পাঠককে চমকে দেয়ার কোনো ম্যাসেজ নেই, ভালোলাগার মূর্ছনায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না কবিতাগুলো। ওই কবিতাগুলো পড়ে মনে হলো মাসুম এখনো প্রস্তুত নন এমন কবিতার জন্য। তার আরো সময় দেয়া উচিৎ এইধরনেএ কবিতার পিছনে।

কবিতা এক স্বতঃস্ফূর্ত সত্ত্বা, যেখানে কবি তার কলমের ছোঁয়ায় প্রাণ দেন কিছু শব্দমালাকে। কবিকে শব্দ প্রয়োগে হতে হয় প্রচণ্ড সচেতন, যাতে কবিতার মূল সুর, শব্দের ব্যঞ্জনা মোটেও ক্ষুণ্ণ না হয়। কবির বিন্দুমাত্র অসচেতনতা কবিতাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। শব্দগুলো আরোপিত মনে হতে পারে পাঠকের কানে। মাসুম তার কবিতায় কিছু অসতর্কের ছাপ রেখেছেন। কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রতিটি কবি তার কবিতাকে নিয়ে এইরকম পরীক্ষানিরীক্ষা করে থাকেন। মাসুমের "ঘর'' কবিতায় আঞ্চলিক ভাষা আর প্রথাগত ভাষার মেলবন্ধনে কবিতা লেখার প্রবণতা চোখে পড়লো। ঘর কবিতার চুম্বক অংশ এখানে শেয়ার করছি
     ''পূর্বে হয়তো বসবাস ছিলো কারো
       এখন শূন্য ফাঁকা ঘর। যাওয়া আসা ছিলো আমারো
       বড় সাধ জাগে ঘরের মালিক হওয়ার
       কিন্তু কী কপাল! ঘরে আমার খাড়ানোর কোনো জায়গা নেই
       ঘর আমারে জায়গা দেয় না তার ভিতর
       দূরে থাইক্যা টানে, কাছে গেলে চুপ হইয়া যায়
       আমার সাধ জাগে ঘরের ভিতর একটু ঘুমাই"
অস্বীকার করছি না, বর্তমানে অনেকে এইরূপ লিখছেন, নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করছেন। তারপরেও সেইসব শব্দমালাগুলো আমার কাছে আরোপিত বলে মনে হয়। কবিতা তার প্রাঞ্জলতা ছেড়ে ইট পাথর আর সিমেন্টের দালানের স্তূপাকৃতি নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। মাসুমের কবিতাটিতেও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

মাসুমের কবিতায় বিদেশী শব্দ ব্যবহারের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় দেখে অবাক লাগলো। জানি না কোনটা সঠিক অনিচ্ছাকৃত নাকি কবি এখনো এই দিকটায় নজর দেন নি, যেটাই ঠিক হোক না কেনো বিদেশী শব্দের নিপুণ ব্যবহার কবিতা কে নিয়ে নতুন এক উচ্চতায়, কবির দক্ষতাকে প্রমাণ করে সবার সামনে। আর কবিতার শব্দ ভাণ্ডার কে করে তোলে সমৃদ্ধ। কিন্তু এইপথে মাসুম একদমই হাঁটেন নি। এটা আমাকে খুব অবাক করেছে। নিজস্ব শব্দ তৈরির কথা এখনো অনেক দূরের কথা।

ভাবনার করিডোরে নতুন কোনো রসদ নাই বা দিলো সূর্যকুসুম, কিংবা সব কবিতা আপনার মনমতো হবে না সেটাও আপনি জানেন, তারপরও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই মাসুম তার লেখনীতে নতুন একটা শব্দস্বর তৈরিতে যে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন সেই পরিশ্রমটুকুকে। চিত্রপট তৈরিতে মাসুমের হাত যথেষ্ট পরিপক্ব। এর পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষায় পারদর্শিতা তার কলমকে দিয়েছে এক অনন্য শক্তি। আবেগকে ছেড়ে দিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলার প্রবণতা আর শব্দচয়নের প্রতি আরো গভীর মনোযোগ দিলে তার কবিতা হয়ে উঠবে আরো প্রাণবন্ত। পশ্চিমা কবিতার টোনের বাইরে এসে নিজস্ব একটা ঢং এর কবিতা উপহার দিয়েছেন সূর্যকুসুম বইতে। এই বইটা সাধারণ পাঠকের জন্য তৃপ্তিদায়ক। সূর্যকুসুম মাসুমের কাব্যপ্রতিভার ভূমিকা মাত্র। তার উপসংহারও মাসুমকে টানতে হবে। মাঝের যেই চর্চাক্ষেত্র তার প্রতি নিরলস খাটুনিতে সূর্যকুসুম মাসুমের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে বহুকাল। পাঠকদেরও কাব্যরসের নির্যাসটুকু জমতে থাকুক আগামীর কবিতার পথে।

লেখকঃ ইমেল নাঈম
              কবি

Friday 26 August 2016

নিঃসঙ্গতাপ্রিয় কোরাস

নিঃসঙ্গতাপ্রিয় কোরাস
- ইমেল নাঈম

পিছুটান ভুলে আগানো শিখি। প্রলেপে ঢাকা দেহ। ভ্রান্তি ঢেকে দেয় গত গ্রীষ্মের আলাপন। হৈহৈ করে ঢুকছে বেয়াড়া বাতাস। আগুনের আঁচটুকু মিলিয়ে যায় অষ্টপ্রহরে। আলোকিত আঁধারের সামনে চুপ করে বসে থাকি, গাণিতিক হিসেবে যত ভুল আয়োজন। আমাকে কুঁড়ে খায় অন্য কোনো দৃষ্টি। অদৃষ্টের নির্বাসন রেখেছে লিখে অচেনা এক ছায়া।

কর্কশ ধ্বনি কানে আসে। আর তার সমান্তরালে ভাসতে থাকে প্রতিবিম্ব। জনশ্রুতি আছে, প্রেমে পড়লে প্রেমিকের মৃত্যু হয়। আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাসী, অথচ চোখ মেলে দেখি না অমোঘ সত্য। ভ্রান্তি পুষে রাখি আত্মপ্রবঞ্চনায়। আমাকে ছিঁড়ে ফেলে নিঃসঙ্গতাপ্রিয় পলেস্তারা খসা দেয়াল।

ওখানে মিথ্যে একটা প্রহসন থাকে
নিজের ভিতরেও অপরাধবোধ
হালখাতায় নবায়ন হয় পরাজয়ের...
কিছু পরাজয়ের অংক এতোটাই সুস্পষ্ট। চাইলেই হাতে ধরে দেখা যায় না। মায়াহীনতায় মরে যাওয়া কোনো এক বৃক্ষের গল্প শোনো। আমাদের সব জ্যোতিষ বিবরণীকে মিথ্যে করে এখনো হাসছে।

বিলাসীতা প্রিয় ছুটির দিনের মায়ায় ক্লান্তি নামে। গুমোট ধরা উষ্ণতা, আমাকে তারিয়ে তারিয়ে দেখছে। গুলতির নিশানা ভুলে গেছে, উড়তে থাকা ফানুস, রাত কে আলোকিত করে। চারপাশে আলোর মেলা। আমিই শুধু পরে থাকি নিঃসীম অন্ধকারে। কেউ জানেনা, পুড়ে যাওয়া স্মৃতিস্তম্ভে খেলাঘরের শেষ দান। সবাই জানে শেষটুকু, জানেনা সময়ের হিসাব।

Nothing can be changed. somebody says to believe in the miracles. But no one knows when, how, which time it has happened ... solitude people doesn't need it, they are buring and burned.

Saturday 20 August 2016

প্রশ্ন

প্রশ্ন
— ইমেল নাঈম

আটকে পরে আমাদের চিরচেনা হরিত কমল। থেমে যাওয়া প্রাচীরের গল্প শোনার মাঝপথেই ঝরে গেলো নীলচে আকাশ। হাহুতাশে ডুবে থাকা মানুষটিও ডিপ্রেশনের বড়ি গিলে চুপ হয়ে গেলো একেবারে। একাদশী সকাল বুনে রাখে শরতের আয়োজন। কাশ কি ফুটেছে? এই প্রশ্ন ইট পাথরের সভ্যতা শুনতে পায় নি কখনো...

শুনেছি শহরের বক্রপথ নাকি গুম করে রাখে অনেক নির্জনতা। উড়তে শেখার বয়সে হারিয়ে গেলো মায়াপথের অনেক প্রহসন। সন্ধ্যা নামলে ল্যাম্পপোস্টগুলো সাজিয়ে বসে বিনোদনের পসরা। তার নিচে একদল যুবার হেড়ে গলায় গান কে অস্বীকার করতে পারে মন্দ না হতে চাওয়া একদল শহুরে মন। হিল্লোলে পুড়তে থাকা পিছুটান, তার বাঁক ঘিরেই এক কোমল আহবান।

ব্যক্তিগত বলে কোনো শব্দ নেই। কারা যেনো ক্ষতবিক্ষত করে গেছে মখমলি পথ। অভিজাত পাড়ার বিলাসবহুল শব্দ উড়ে আসে। মাঝেমাঝে ভাবতে বসি কী সুন্দর সহাবস্থান! আলিশানের পাশেই সাদামাটা, তারমাঝের প্রলেপের জায়গাটায় খুঁজে দেখো, আনন্দের চেয়ে চাপা বিষাদ, আষ্টেপৃষ্ঠে কুড়ে ধরে চারপাশ। এরপাশে দাঁড়িয়ে বক্রতার সীমারেখা আঁকছে অজস্র নাগরিক পঙক্তিমালা।

মধ্যবিত্তে শরতের কোনো আবেদন নেই। তবুও প্রশ্ন করি কাশ কি ফুটেছে? উত্তর নেই, সহাবস্থান আছে... প্রাপ্তি নেই, বিচ্ছেদের অর্কেস্ট্রায় বেজে চলেছে ভায়োলিন।

Thursday 18 August 2016

সেলাইঘর

সেলাইঘর
- ইমেল নাঈম

দর্জি রিপু করে দেয় শরীরের সমস্ত ক্ষত।
ব্যান্ডেজে চুইয়ে শুধু রক্তক্ষরণ; তবুও
বাকহীন স্বাধীনতায় ওড়াচ্ছি কবুতর।

উড়তে থাকে জাতীয়তাবাদী পতাকা
শ্লোগানে মুখরিত চারপাশে অলক্ষ্যে
ঝরে গেলো আঁচল! ছড়ালো রক্তকণা

নাম বদলায়, গল্পের চরিত্র নয়
সময়ের সুমিষ্ট  মেডিসিন গিলতেই
ঘুমিয়ে পড়ছি প্রতি মুহূর্তে,
জেগে উঠছি ক্ষতবিক্ষত শরীরের
নিথর প্রতিবাদে, ঘুমিয়েও পড়ছি আবার।

আমরা ঘুমোলে তারা দেখতে আসে,
অত:পর ফিরেও যায় অচেনা বন্দরে
ওদিকে দর্শনার্থী বাড়ছে ক্রমাগত
সেইসাথে ঘুরছে সেলাইঘরের মেশিন।

Tuesday 16 August 2016

রাত বিভুঁই
- মধুবন্তী মিত্র দাশগুপ্ত

চাঁদের পাশে একটা বাড়ি। সেই বাড়ির দেওয়ালে কোন এক লিখন। সেসব পড়া যায় না। বাড়ির চারপাশে নীল পাহাড়। পাহাড়ের ঢাল নেমে এসেছে টলটলে জলে। তার কিনারে মেঘের মত চুল নিয়ে জলপরীরা জ্যোৎস্নার সুরে গান বাঁধে। তোমার চোখ নেশাতুর। তোমার মাথায় হালকা চলন। তোমার শরীর জুড়ে দুলুনি। শীত এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তোমার রাতগুলোকে।

ধোঁয়ার মত তোমায় ঘিরে ধরছে বিভুঁই। পাহাড়ী গান ভেসে আসছে। অদূরেই পায়ে চলা পথ। গাড়ী পথ। ধূসর বেদনার ছাপ তোমার চোখে নিসর্গ এঁকে দেয়। তোমার ফোনে কোহেন বাজে। কিংবা বব ডিলান। তারা স্বপ্নের মত এই উপত্যকায় তোমায় প্রেম দিয়ে যান মুচকি হেসে।

দোকানপাট আছে কিছু। চায়ের ঘন ধোঁয়া, আদার ঝাঁঝ আর দুধের মিষ্টি গন্ধ লাগছে নাকে। তোমার চোখ আরো নেশাতুর হয়ে ওঠে। গেলাসে পড়তে থাকা ঘন সোনালীর ভেতর তুমি 'দু-দন্ড শান্তি' খুঁজতে থাক। তোমার কোন বনলতা সেন নেই।

ধরা যাক, কোন এক লক্ষ্মীপেঁচার চিৎকারে তোমার চোখ চলে গেল চাঁদের দিকে। ধরা যাক, 'এখানে মেঘ গাভীর মত চড়ে'। ধরা যাক, এই সময় তোমার হাত দুটো কম্বল খুঁজছে ক্লান্তি লুকোবে বলে।

তোমার পৃথিবী এই আবার শুরু হল। তোমার গল্পকার নিসর্গ লিখে দিলেন রাতের নামে। শান্তি নেমে এল। স্বর্গ নেমে এল। কাল আবার ভোর হবে। সোনালী রঙে তোমার চোখ ধুয়ে যাবে। নেশা কেটে গিয়ে উঠে বসবে তুমি। কাল রাতের পাহাড়ী রহস্য মনে পড়বে তোমার। আর হয়তো ঘুমের গোপনে দুটো লাল, ফোলা চোখ। তোমার ফেরার পথ চেয়ে কত রাত ঘুমায়না তারা।

নবুরিহো কুরুসাকি

iনবুরিহো কুরুসাকি
- ইমেল নাঈম

রয়ে যায় আর্তনাদের ভাষা, অকুণ্ঠ সমর্থনে
মুহুর্মুহু হাতেতালি, বারবার আঘাত হানে
দক্ষিণের দরজায়, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ক্রমশঃ
দূরের শহর - ওই শহরে সবাই অতিথি
দায় নেই, বন্ধ দরজা ঢাকা কালো কাপড়ে

নিথর দেহ, প্রাণহীন স্পন্দন, কঠিন বাস্তব
দাঁড় করিয়ে দেয় অচেনা ভূমি, পরাজয়ের
নামতা গুনতে বসে হারিয়ে ফেলেছি বিজয় মিছিল
হন্তারক পালিয়ে যায় পুনরায় ফিরবে বলে
জিঘাংসার বিজ্ঞাপনে দুলছে পুরো মানচিত্র।

একটা রক্তস্নাত সন্ধ্যা, হামাগুড়ি দিয়ে জানায়
চলে যাওয়া মানুষগুলো আমাদের অপরিচিত
ঘুম ভাঙতে দেখি কর্কশ শ্লোগানে মুখরিত
বন্ধ্যাপথে ফলন নেই, অকর্ষিত জমিতে আগাছা।

এই শহরে নিষিদ্ধ হচ্ছে সৃষ্টির আয়োজন
কাফেলার সাথে চলে গেছে প্রতারক চোখেরা
ক্রুসেডের কল্যাণে ঘড়ি ছুটছে উলটো পথে
রাজনীতিবিদ খেলছেন দাবা ক্ষমতার অংকে

নিবুরিহো কুরুসাকি চলে গেছেন প্রাণাঘাতে
ষোলোকোটি মুখ সুরেলা কণ্ঠে পাঠ করছেনঃ
তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার...

Monday 15 August 2016

ভিনসেঞ্জো ডি'অ্যালেস্ট্রো

ভিনসেঞ্জো ডি'অ্যালেস্ট্রো
ইমেল নাঈম

ভেলভটমের জামা আর পোশাকি আচরণ, রেখে দাওয়া এক আঁজলা উষ্ণতা। বর্গী আসে না দেশে। তাই দেশের মানুষই সাজে বর্গী। ভুল ব্যাখ্যায় অতিবাহিত হয় রঙচঙে বিজ্ঞাপন। বিশ্বাসকে আঘাত করে ফিরছি প্রতিদিন। অন্যকে নামিয়ে দিচ্ছি নিচে, সিঁড়িটা আকাশ ছোঁয় নি, মাটিতেই লাগানো তার পা। কাল্পনিক শূন্যতায় আঁকা সিংহাসন।

রক্ত ধারা বয়ে যায় অচিনে, কেউ কখনো আঁকে নি সৌহার্দ্যর আলিঙ্গন। আমাদের অনেক ভুল পথের আবেশ থেকে যায়। ছিঁড়ে খায় নিজের ভিতরকার জমাটবদ্ধ আলপনা। ঠিক করে জানা হয়নি সাজানো পথ কিভাবে অপরিচিত হয়ে যাবার আয়োজনটুকু। তারিখ বলে না সারাদিনের সালতামামি। কোনো কোনো তারিখ নিজেই হয়ে ওঠে অচেনা।

ভিনসেঞ্জো ডি'অ্যালেস্ট্রো, আপনার শরীর বেয়ে পড়ে যায় রক্তধারা। ধর্মের মোড়কে বাঁধা আততায়ী গুলি কেড়ে নিয়েছে আপনার প্রাণ। আপনি অসহায় ভাবে হয়তো স্মরণ করার চেষ্টা করছিলেন জেসাস কে।  ইসাও খুব অসহায়। নির্বিকার শুনে গেলেন আপনার গোপন প্রার্থনা।

দিন ফুরোলে সবাই বলে উঠে শান্তির কথা। শাদা পায়রা উড়ে যায় দূরে। তারা ফিরেও আসে। এরইমাঝে রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে, ভুলে যাওয়ার অনেক কিছুর মাঝে আজও মনে রেখে দিই, একটা গভীর অন্ধকারের পথে চলে যাওয়া যাত্রীকে আলোর পথে আনতে অন্ধকারেই পথ হাতড়াচ্ছে ষোলোকোটি স্বপ্নিল প্রাণ।