Friday 30 September 2016

পাহাড়ের কবিতা

পাহাড়ের কবিতা
— ইমেল নাঈম

চশমায় লুকিয়ে রাখি অভিমান। বাষ্প জমে ভিজে লেন্স। টুপটাপ বৃষ্টির ছবি। ক্যানভাসে আঁকা স্বপ্নকথা। ভুল শব্দে লেখা অজস্র চিরকুট। অবহেলায় জমে থাকা সিগারেটের প্যাকেট। খেলার মাঠে দুরন্ত শৈশব। দূরত্ব পার হলেও একটা পিছুটান থাকে। নাটকের মতো, অনেক সংলাপের আনাগোনা। বিরতিহীন কোন এক নৈশকালীন আন্তঃনগর গাড়ীর যাত্রাপথে ছুটে যায় বেপরোয়া গতিতে। হায় দুরন্ত মন! তোমাকে লাগাম টানা শেখাবে কে? বারবার মোহিত হয়ে যাও কারণ বা অকারণে। জলছবিতে আঁকড়ে ধরে চোখ।

প্রপাত বুকে পাহাড়ের অনেক স্মৃতিচিহ্ন। অনেক জন্ম দাগ নিয়ে সেও কেঁদে যায়। কিছুটা আনন্দের ফোটা দিতে গিয়েও বারবার থেমে যায়। হয়তো বা থেমে যেতে হয়, কিম্বা তাকে থামিয়ে দেয়া হয় অযথাই। মুক্ত বাতাসের আলিঙ্গনে লুকানো থাকে অনেক ঘটনা। অক্সিজেন — হিমশীতলতা আমার, মেঘের সারিতে লুকানো অনেক হিসেব নিকেশ আজো বাকি রয়ে গেছে শুভ্র কাশের মেলায়। শিউলি ফুটেছে অনেক নিচে, উপরে অচেনা বুনো ফুলের বাহারি সমাবেশ। সমবেত গাছেদের ভিড়ে উঁচুনিচু পথের সমারোহে, ক্লান্তি এসে ভেসে ভেসে যায়।

সমতলে কেউ কাউকে চিনে না। সবাই ছুটে চলে সারিবদ্ধ জীবনের পথে। কাঁধে কাঁধ অথচ প্রতিযোগিতা। চিনে নেয়ার আবেশে আজও রেখে দেয়া ইকেবানা। বনসাই বৃক্ষ জানে নাগরিক সভ্যতার খর্ব চরিত্র। এখানে কোনো বিন্দু নেই, বৃত্ত নেই, সরল রেখা নেই, জ্যামিতির উপপাদ্য বা সম্পাদ্য কিছুই নেই। ত্রিকোণমিতির মাপজোখের আড়ালে কোনোরূপ প্রহসন লুকিয়ে নেই। বিশালতার ক্যানভাস জুড়ে প্রেম আঁকা আছে। প্রহসন শব্দটা এই অভিধানে নেই। নেই বলেই হয়তো প্রেম শব্দটি এখানে কখনোই আসে নি। প্রেম খোঁজার নেশাতেই নিঃস্ব হয়ে বারংবার রক্তাক্ত হয়ে গেছে পাহাড়।

Thursday 29 September 2016

হারানো বিজ্ঞপ্তি

হারানো বিজ্ঞপ্তি
— ইমেল নাঈম

নিত্যদিনের যাওয়াআসায় মুখ দেখা পরিচয়।
ইদানীং আর দেখিনা, জীর্ণবস্ত্রাদি চাপিয়ে আকাশ
দেখতে ভালবাসতো ছেলেটি, হাতের মুঠোয়
লটকে রাখতো একটা খাতা। কিসের খাতা জানা
হয় নি আজো....গতকালও ছিলো শেষ দেখা।

আজ নেই। এলাকাবাসীর সাথে আলাপে জানা
যায় হারিয়ে যাবার সময় গতরাত আনুমানিক
সাড়ে দশটা — শুধু ফেলে গেলো খাতা।
খাতায় লেখা এই পৃথিবীর মানুষ যুদ্ধ বড্ড
ভালবাসে, কবিতা নয়! প্রতিটি যুদ্ধের সফলতা
অজস্র কবিতার মৃত্যু দিবস হিসেবে পালিত হয়।

ছেলেটির নাম জানা নেই, ছবিও নেই যে দেখাব।

Tuesday 20 September 2016

দাবী

দাবী
— ইমেল নাঈম

সারিসারি দালানকোঠায় ছুঁয়ে দেখেছো আকাশ।
অনেক গল্পের ভিড়ে লেখা কবিতা নামক শব্দবাজি
ছুঁয়ে দেখেছো কতটা তার, গভীরে হারিয়ে যাও
বিভ্রান্তি ছড়াতে ছড়াতে অনেক দূরে, ইট পাথরের
সভ্যতাকে চুমু খাও চৌরাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে
বিন্দাস সময়ে উড়িয়ে দাও হাহাকারের আবাসন

ছিঁড়ে ফেলো অলংকার, কঙ্কালসার দেহ বেরোয়
আমিও হাপিত্যেশ ঝরাতে ঝরাতে খেয়ে নিই
দুই পেগ বিষণ্ণতা, আরো দু'পেগ বেশি পেটে
গেলে নিজেকে জুই কোয়ানের মাস্টার মনে হয়,
অদ্ভুতুড়ে এই নৃত্যকলা বস্তুত সার্কাসের ক্লাউনের
লোক হাসানোর ব্যর্থ একদল অঙ্গভঙ্গি।

ছুঁড়ে ফেললাম বাড়ানো আঙুলের সব জড়তা,
কথা দিইনি গত জন্মের, পাপের হিসেব নিকেশে
অহেতুক গল্পের ভিড়ে নেমে আসে নিবিড় সন্ধ্যা।
আমি শ্রোতা আমিই গল্পকথক, নিজেকে নিজের
গল্প শোনাতে শোনাতে হারিয়ে গেলাম আঁধারে।

দূরে চলে গেলাম লৌকিক জীবনের পাঠ থেকে।
নগর, প্রতিদিন তুমি সভ্যতার বীজ রোপণ করো
লোক দেখানো উৎসবে, এই শহর কবিতার নয়...
নগর তুমি বরং একটা নদী কিনো শুকনো বুকে।

(বিঃদ্রঃ জুই কোয়ান কুং ফু'র একটা স্টাইলের নাম, যেটাকে ইংরেজিতে ড্রাংকেন স্টাইল বলে।)

Monday 12 September 2016

দৃষ্টিরেখা

দৃষ্টিরেখা
 — ইমেল নাঈম

বদলে যাওয়া অনেক কিছুই শুনি। দূর থেকে দূরে চলে যেতে পারে ছায়ারা। ক্লান্ত মুঠোফোনে রয়ে যায় কিছু স্মারকচিহ্ন। সেখানে পুঁতে এসেছি স্মৃতিগাছ। ফলন নেই, অথচ তীব্র ব্যথার বুনন। নকশিকাঁথার নকশায় আঁকা, সৌর পঞ্জিকা জুড়ে বিচ্ছিন্ন কিছু দাগ, ভ্রান্তির কথা বলতে বলতে মুছে গেছে অর্বাচীন সুখে।

সমাপ্তি রেখা আঁকছিলাম খুব। ধুধু মরুভূমিতে মরীচিকার আবাসন দেখতে দেখতে ভুলে গেছি সভ্যতার উলটো পথে পেরিয়ে যাচ্ছি নিজের সাথে ক্রমাগত প্রতিযোগিতা করে। উড়ে যাচ্ছি, কাবু করে ফেলছি নিজেই নিজেকে। অথচ প্রতিপক্ষ চেনার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়াই নি বহুকাল। অস্থিরতার পরিমাপক পাইনি বলে বুঝতে পারিনি অসুখের তীব্র স্পন্দন।

প্রতিধ্বনি শুনে চমকে উঠি। চেনা কণ্ঠস্বর অচেনার বেশে নিজের কানে এসে জানান দেয়। পতনের অংক করি, কেই বা জানতো অচেনা হতে পারে বাম অলিন্দ। চুপচাপ অন্বেষণ করি, আনত মস্তকে খুঁজে ফিরি কুহেলিকা প্রহর, অর্থ খুঁজি — খুঁজি সমাধান। সমস্যার বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে ভুলে গেছি শিকড়।

রঙিন চলচিত্ত'র চালচিত্র বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করি। সমাধান নেই, সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু থেকে ছিটকে গেছি অনেক আগেই। বিচ্ছেদ শুনি অনবরত, দেখি দূরে সরে যাচ্ছে একে একে সবাই...

Friday 9 September 2016

সাঈদ ভাইকে নিয়ে

সময়টা ঠিক মনে নেই। মনে হয় ২০১০ বা ১১ হবে। কবিতা লেখার ঝোঁকটা মাত্র চেপে ধরে ধরলো। তখন নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে ব্লগিং করতাম, শব্দনীড় নামের ব্লগটিতে। সেখানেই ওনার লেখা পড়া। হরবোলা নিকে লিখতেন। প্রথম ব্লগ পড়ে মনের ভিতরে নাড়া দিয়ে উঠলো। পোস্টের নিচে ওনার ফেইসবুক আইডিটার লিংক দিয়ে দিতেন। এইভাবে শুরু হয় ওনার সাথে পরিচয়।

কৃতদাসের নির্বাণ নামে লিখতাম। ক্রীতদাস বানান ভুল দেখে পরে দিয়ে ইমেল নাঈম নামেই ফিরে আসি। প্রথম চ্যাটেই উনি আমাকে জানালেন আমেরিকান অল্টারনেটিভ রক ব্যান্ড নির্ভানা'র কথা। ওনার খুব প্রিয় ব্যান্ড। বুঝলাম এই ছেলে দেখি গান পাগল আমার মতো। নাহ, উনি আমার চেয়েও বেশি। অবসকিউরে ওনার দুইটা গান সিম্পলি অসাম।

পরে দিয়ে কবিতা নিয়ে অনেক কথাই হয়। অনেক কথাই হারিয়ে ফেলেছি সময়ের ভিড়ে। একটা কথা কানে বাজে, "তুই আজকে যা লিখবি, দশদিন পরে মনে হবে কিছুই হয়নি।" উত্তরে বলেছিলাম, কই আমার তো এমনটা মনে হয়নি। আসলেই কত কাঁচামাথার কবি ছিলাম।

ঘুমিয়ে পড়লে সকালে উঠলে ইনবক্সে কবিতা পাঠিয়ে দিতেন। পড়তাম, অনেক কবিতার কিছুই বুঝতাম না, আবার কিছু কবিতা পড়ে মোহিত হয়ে যেতাম। উনি কেনো কবিতা লিখেন না, জিজ্ঞেস করলে বলতেন ওনার মনে হয় ওনার কবিতা কিছুই হয় না, তাই লেখা ছেড়ে দিছেন কবিতা লিখা। আমি এখনো বিশ্বাস করি উনি কবিতা লিখলে ভালো করবেন। উনি সাজেস্ট করতেন ফেবুতে কার কার লেখা পড়বো আর কারটা পড়বো না। ওখানেও একই সমস্যা, কবিতা বুঝি না.... তবু পড়তাম, অজানা কে জয় করা নাকি কবিতা লেখার চেষ্টা কোনটা এটার মূল কারণ ভেবে দেখা হয়নি।

লেখালিখি জগতে অনেক উপদেশ পেয়েছি ওনার থেকে। একটা আফসোস আছে হাজারবার বলে কয়ে একটা বই বের করাতে পারি নি ওনাকে দিয়ে। গতবার সূচীপত্র প্রকাশনী থেকে অণুগল্পের বই বের হবার কথা থাকলেও কেনো জানি আর বের হলো না। এই অতৃপ্তিটা আমি অনেকদিন বয়ে বেড়াচ্ছি।

নোট ১: এখন একটা কবিতা লিখলে ১০ দিন অপেক্ষা করতে হয় না, দুই দিনের মধ্যে মনে হয় কিচ্ছু হয় নাই। :/
নোট ২: এখন কবিতা বুঝতে চাইনা, অনুভব করতে চাই। পৃথিবীতে অনেক না বোঝার মধ্যে এটাও থাকুক না আদরে, যতনে।
নোট ৩: এখন না লিখলে মনে হয় লিখি না ক্যান, আর লিখলে মনে হয় এইটা কি লিখছি। সত্যি বিরক্তিকর অবস্থা।

বিঃদ্রঃ আমার জন্মদিন ২৭ সেপ্টেম্বর। আর এই ছবিটার সাথে জন্মদিনটা এক্সেপশনাল থাকুক। এক্সেপশন তো এক্সাম্পেল না, এক্সাম্পেল হলো সাঈদ ভাইয়ের জন্মদিন। হ্যাপি বার্থডে সাঈদ ভাই।

Tuesday 6 September 2016

সন্ধ্যার বালুঘড়ি

সন্ধ্যার বালুঘড়ি
- ইমেল নাঈম

থেমে যাওয়া দেখতে দেখতে সবটুকু অদৃশ্য হয়
মায়াপাথর আঙুলে জড়িয়ে হেঁটে চলে ছায়া
বড় হতে হতে মিলিয়ে যায় একেবারে; প্রান্তিক
শব্দদের অসহায়ত্বের শ্লোগান শুনিনি কতদিন

পরশপাথরে লিপিবদ্ধ নেই, ধ্রুপদী সঙ্গীতের
আবেশে কল্লোলময় সন্ধ্যার অবসান ঘটে
পরাবাস্তব স্বপ্নের কল্যাণে, এরচে' বেশি প্রমাণ
খুঁজলে ব্যর্থ বিক্রিয়ার জন্ম হয় আশেপাশে...

অবশিষ্ট সময়ের অবসর যাপন, বখে যাওয়া
মনছবি, কোন এক জায়গায় ব্যর্থতার ছাপ
পুষতে পুষতে অকালেই ঝরছে বুনোফুল।
না বুঝেই তাকিয়ে আছি ক্লাউনের অঙ্গভঙ্গি,
বাকি রিং মাস্টারের আঙুলের সুনিপুণ খেলা।

সার্কাসের বাতি বন্ধ হলে স্বপ্নের দরজা বন্ধ হয়...
পরাবাস্তব সময়ের ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে
সুখটানের নিমিত্তে উড়িয়ে দিই যত দুঃখবোধ
সেই সময়েই নিজেকে সিনেমার নায়ক মনে হয়

যত অদ্ভুত আয়োজনে বসে থাকি চারপাশে
অকারণে, যাজকের মতো অদৃষ্ট মাপতে থাকি
হারাতে হারাতে ভাবতে পারো ছায়ার পিছনে
অন্ধের মতো দৌড়ানোর কঙ্কালসার ব্যাখ্যা।

কিছু অলীক, বাকীটা কল্পনা, জীবনের বালুঘড়ি
এখনো বিরতিহীন ছুটছে বহতা নদীর মতো...

Friday 2 September 2016

হাঁস ও ডিঙি নৌকো

হাঁস ও ডিঙি নৌকো

—  ইমেল নাঈম

পথের দূরত্ব অনেক। থেমে যাওয়া নদীর মতো দীর্ঘশ্বাস। স্রোতহীন বয়ে সময়ের অচেনা প্রতিধ্বনি। সামনে যা দৃশ্যমান, দৃশ্যত তার সবটাই মিথ্যে। ছুটে চলতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে রাজহাঁস। পানকৌড়িদের শহরে সন্ধ্যা নামে না এখন। মাছরাঙা — সেও ক্লান্ত দিনভর জলের সাথে লুকোচুরি খেলে।

ডাঙায় বাঁধা ডিঙি নৌকো। এখানে কোনো ঘাট নেই। জনসমাগম আসে না, সৌখিন মানুষ ওই ঢালু জায়গায় বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরে। আর পুরোটা সময় জলরাশিতে ভেসে বেড়ায় একটা হাঁস। আমি কখনো দেখি নৌকোটিকে দূরে ভেসে যেতে। খুব ইচ্ছে করে একবার জলে ভাসি, ভাসতে ভাসতে যতটুকু ভেসে যাওয়া যায় শব্দ আর ব্যঞ্জনে।

কিশোর বয়সী ছেলেরা এখানে আসে না, যারা আসে তারা সবাই বৃদ্ধ নাগরিক। আমিই মনে হয় ব্যতিক্রম। শরতে ভেসে যাওয়া একদল মেঘের সাথে সাক্ষাত হয়। তার ফাঁকফোকরে উড়তে থাকে অজস্র কথামালা। তারা অবশেষে শ্রান্ত হয়ে ফিরে যায় তাদের দেশে। শুভ্র হংসটি তখনো ভেসে বেড়ায় আপন মনে। এই ছুটে চলার কারণ জানতে ইচ্ছে করে নি কখনো।

আমি তার আনন্দে চিত্তে ছুটে চলার পাশাপাশি, ডাঙায় বাঁধা নৌকোটিকে ভাবি। নিজেকে তার সমতুল্য মনে হয়। একদল শুধুই দেখে চলেছে হাঁসটিকে। আরেক দল দেখছেই না। নৌকোটি নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই, সে না থাকলেও মনোরম দৃশ্যটি ম্লান হবে না শিল্পীর তুলির আঁচড়ে।