Monday 15 February 2016

জীবনের পাঠ

প্রিয়তা,
আমাদের কোনো অন্ধকার নেই, চাইলেই ফানুশ উড়িয়ে দিতে পারি এইখানে। ঠিক এইখানটায় তোমার আমার বসত। ওইখানে একটা শানবাঁধানো পুকুর ছিলো। সেখানে সেজো চাচার মাছের ঘের। আমার ছিপ দিয়ে মাছ ধরার ইচ্ছেটাতো তুমি জানো। বংশের ছোট সন্তান মানেই অতি আদরের বাঁদর। আমার এইসব অতিরঞ্জিত ছেলেমানুষি গুলোতে কখনোই কেউ কিছুই বলতো না। সেজো চাচা তো একদম মাটির মানুষ। তোমরা থাকতে ওই খানে। মানে ওই বাড়ীটায়। দোতলা পুরনো বাড়ী, মাঝেমাঝে তোমাকে দেখতাম বাড়ীর ছাদে। বেশিরভাগ সময়েই দেখতাম না।

কখনো যে তোমাকে ভালবাসবো বুঝি নি। ভালবাসাও যে কাউকে কিছু না বলে, এইভাবে আগন্তুকের বেশে এসে মিলেমিশে যাবে বুকের গভীর কোনো প্রদেশে। আর সেটাই নিয়ামক হয়ে ছড়িয়ে যাবে পুরো শরীরে কেই বা জানতো তা। তোমার সাথে আমার কোনো কাজেই মিলতো না। এমন কি তোমার যত অভিযোগ ছিলো আমার দিকে। আমার ক্রিকেট খেলা, মাছ ধরা, ছাদে উঠে ঘুরি ওড়ানো সবটাতেই যেন তোমাকে আড়চোখে দেখার জন্য। অথচ আমার কল্পনার কোনো স্তরেই তোমার দেখা পাওয়া দুষ্কর নয় একেবারেই দুঃসাধ্য ব্যাপার।

তোমার মনির মামার কথা মনে আছে, আব্বাকে একবার বিচার দিয়েছিলো আমি নাকি তোমার কলেজে যাবার পথে দাঁড়িয়ে থাকি। তোমার হাতে ধরিয়ে দিই কোনো চিরকুট। অথচ, আমার ওই রাস্তার মোড়ে যাওয়াই হয় না একদম। সেইদিন আব্বা আমাকে বেদম মেরেছিলো, আর তার ফলাফল ১০৩ ডিগ্রি জ্বর। অতঃপর ডাক্তার বাড়ী দৌড়াদৌড়ি। জানি না, এতে কি সুখ পেয়েছিলো তোমার মামা কিম্বা তুমি। এরপর বাবা অনেকটা শিশু বাচ্চার মতো কেঁদেছিলেন। পরের দিকে এটা নিয়ে কম দেন দরবার হয় নি।

আমার কবিতা লিখার অভ্যাস টা আমার মা ব্যতীত কেউ জানতো না। আমার বন্ধু রাতুলের কথা মনে আছে তোমার। ভুলে যাবার নয়। সবাই ভুললে অন্ততপক্ষে তুমি ভুলবে না, এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। ব্যান্ড পাগল একটা ছেলে। ছন্নছাড়া, তবে মেধাদৃপ্ত চোখ। একটা গানের দল করতো। তুমিও তো সেই দলের সাময়িক সদস্য ছিলে। তারা পুরনো ক্লাব ঘরটায় নিয়মিত প্র্যাকটিস করতো। সেটার সূত্রে তোমার সাথে আমার সখ্যের ধারাপাত। আমি অবশ্য ওটার কোনো স্থায়ী বা অস্থায়ী কোনো ধরনের মেম্বার ছিলাম না। শুধু কবিতার জোরেই ওদের সাথে মেলামেশা।

জীবনানন্দ আমার খুব প্রিয়। অবসর পেলেই ওই কবিতাটা আওড়াতাম।
"সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;"
জানতাম সুরঞ্জনাদের সাক্ষাৎ চাইলেই মেলে না। তবে তুমি যে গোপনে পিছনে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনতে, জানতাম না। যেদিন তোমার উপস্থিতি কানে এলো সত্যি আমি লজ্জায় পরে গেছিলাম। এরপরে তুমি আমাকে একদিন জীবনানন্দের গদ্যসমগ্র কিনে দিলে। আর ভিতরের পাতায় লিখলে, এই লাজুক ছেলেটার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি দিন দিন। সেদিন সত্যি লজ্জাই পেয়েছিলাম প্রিয়তা।

এরপর কলেজ লাইফ পার করে বিশ্ববিদ্যালয়। তোমার আমার প্রেমটাও মফস্বল পেরিয়ে শহরে। তোমার মনির মামা তখনও আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। আমরাও নাগরিক শালিক দম্পতি হয়ে টইটই করে ঘুরছি এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত। তুমিও ছেড়ে দিলে গান, যদিও রবীন্দ্র শুনতে তোমার গলায়....আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা, অথচ ক্যাম্পাসে আমরা পাশাপাশি সবসময়। জিইসির মোড়ে ক্যাফেটেরিয়ায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝুপড়ি ঘর। অনেক স্মৃতি টুকরো টুকরো প্রহরে আমাদের নাড়া দিয়ে যায়।

তুমি হয়তো ভুলে গেছো। আবার মনেও রাখতে পারো। আসলে আমাদের পথ এতোটাই বেঁকে গেছে মনে রাখাটাই অনুচিত। আচ্ছা দিপুর টঙ দোকানের চা খেতে খেতে কোনো এক অঝোর বৃষ্টি তে তোমার ঠোঁটে প্রথম চুমুটা....নাহ তাকেও ভুলে যাও। আমার তো খুব কষ্ট হয় প্রিয়তা।

ইতি,
রোদ্দুর
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৬

No comments:

Post a Comment