Sunday 28 August 2016

সূর্যকুসুম মাসুমের কাব্যপ্রতিভার ভূমিকা মাত্র - ইমেল নাঈম

পরাবাস্তব আর উত্তরাধুনিক কবিতার ভিড়ে পাঠক যখন এক অচেনা গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছেন অনবরত, কবিতার অতলে ডুবে যাচ্ছেন অথচ জানেন না কোথায় ছুটে যাচ্ছেন, বুঝতে পারছেন শেষ দরকার, অথচ বুঝতে পারছেন না এর শেষ কোথায়, দিন শেষে অভিযোগ আর অনুযোগে ভাসিয়ে দিয়ে বলছেন "কবিতা বুঝি না"। পুরো লেখাটা আত্মস্থ করতেই পারছেন না, বারবার বলছেন মাথার উপর দিয়া গেলো লেখাটা.... সত্যি কথা বলতে আমি নিজেও ভয় পাই, এমন কবিতাগুলোকে।

গ্রামের সোঁদা গন্ধ, মফঃস্বলি বাঁক, নাগরিক জীবনের টানাপোড়ন এইসব নিয়েই দীর্ঘপথ এগিয়েছে কবিতা, কবিতায় যোগ হয়েছে নিজস্ব দর্শন, এরবাইরে যোগ হয়েছে বিজ্ঞান, রাজনীতি, ভাষাতত্ত্বের মতো মজাদার বিষয়। কবিতা পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য নয়, আনন্দদায়ক করে তোলার কাজটা সত্যি কঠিন কিছু নয়, খেয়াল রাখতে হয় অপ্রয়োজনীয় গিমিক বা চমকে দেয়ার প্রবণতা আর রূপকের ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করলে। মাসুম মুনাওয়ারের প্রথম বই সূর্যকুসুম বইটা তার স্বার্থক নাম না হলেও মাসুমের প্রয়াস সত্যি প্রশংসা কাড়ার মতো।

First sight at Love - বাক্যটি নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। নানা মতের সমাবেশ হতে পারে দশদিক হতে। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে এই বাক্যটি অন্যান্য যে কোনো বাক্যের চেয়ে বেশি জোরালো ও শক্তিশালী মনে হয়। সূর্যকুসুম যখন হাতে আসে তখন রোজার ঈদের ছুটি আর দেশের সামগ্রিক অবস্থায় মনটা অনেক বিক্ষিপ্ত ছিলো। বইটায় হাতে নিতেই চোখ পড়লো চারু দা মানে আমাদের চারু পিন্টুর মনোরম প্রচ্ছদ। বুঝতে পারলাম প্রথম দর্শন আর প্রেমের মাহাত্ম্য। ৪ ফর্মার বই, কবিতা সংখ্যা ৫২ টি। প্রতিটি কবিতায় গ্রামীণ দৃশ্যপট, দেশ, রাজনৈতিক ক্ষোভ, প্রেম বিরহ, নানা রকম অন্যায় অবিচার উঠে এসেছে অবলীলায়। পুরো বইটি জুড়ে সরলতার পাঠ, কোনো দুর্বোধ্যতা নেই। শব্দ বিন্যাসগুলো সহজ কিন্তু সাবলীল। সাধারণ পাঠকের জন্য একটা ঘোর তৈরি করার মতো উপাদান অন্তর্নিহিত আছে, আর পাঠক যদি হোন বিচক্ষণ, তবে তার জন্য রয়েছে ভাবনার ট্যুইস্ট।

আলোচনা শুরুর আগে একটা চমক অপেক্ষা করছিলো বইটা খুলেই বুঝতে পারছিলাম। কিছু কবিতার নামকরণ সত্যি চমকে দেয়ার মতো, একটি বর্ণমালায় একটি কবিতার শিরোনাম। প্রথম কবিতার নাম অ, পরেরটির নাম আ। সাধারণত কবিতার বই আমি শেষ পাতা হতে পড়ি। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হলো না। নিঃসঙ্গ বাদর পড়তে গিয়ে পেলাম,
      "অ- কথা বলে না
       নি- কথা বলে না
       রা- কথা বলে না
       কোন নারীই কথা বলে না।"
ভাবছিলাম অ, নি, রা (অনিরা ভেবেছিলাম একবার) এই ছোটোছোটো নামগুলো সেই কৈশোরকালীন চিরকুট প্রেমের কাছে নিয়ে গেলো। অ দিয়ে প্রেমিকার আদ্যাক্ষর। বা এমন কোনো সংকেত যা অন্যদশের কাছে অজানা। ভাবনার মোহ থেকে বেরিয়ে আসতেই নিঃসঙ্গতার বিজ্ঞাপন। শেষ পঙক্তিতে এসে বললেন জলস্রোতের কথা, শহর ডুবে যায় না পাওয়া ব্যর্থতায়, কিন্তু প্রেম... না পাওয়ার মাঝেও তা ভাস্বর।

বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক কবিতাকে একসময় অনগ্রসর শাখা হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। যদিও ভার্চুয়াল যুগের কল্যাণে বর্তমানে কবিতায় আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। সেটা প্রয়োগের দিক থেকে নিপুণতার প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে অনেক মুখ। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয় আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখা কঠিন। একটা অঞ্চলের ভাষার উপর পরিপূর্ণ জ্ঞান, অদ্য অঞ্চলের মানুষের কথা বলার ধরণটুকু আয়ত্ত করলেই হয় না, অন্যান্য জেলার মানুষের জন্য কবিতাটা কতটুকু প্রাঞ্জল আর বোধগম্য হয়ে উঠছে কিনা তাও কবিকে খেয়াল রাখতে হয়, এরজন্য কবিতার যে সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যাবলীর ব্যত্যয় না ঘটে তার জন্য তাকে হতে হয় অনমনীয়। কবিতায় সবুজকে তুলে আনা, স্যাটায়ারের মাধ্যমে আঞ্চলিকতার রেশ টেনে সবুজ বাঁচানোর যেই আন্দোলন বর্তমানে চোখে পরে তাই যেন মাসুমের কবিতায় উঠে এসেছে সাবলীলভাবে।
       "চান্দিনা রাইতে যতদূর দেখা যায় শুধু শেয়াল আর শেয়াল
        শতে শতে শেয়াল, হাজারে হাজারে শেয়াল
        পণ্ডিতগণ একসাথে ডাইকা ওঠে --
        জংলা রক্ষার দাবী-- আঠারো হাজার মাখলুকাত রক্ষার দাবী"

নেত্রকোনার ভাষাতেই কবি তুলে ধরেছেন শেয়ালের বন রক্ষার সমাবেশ -- যা অনেকটা আমাদের মানব সমাজের কোনো একটা দৃশ্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আঞ্চলিক কবিতা পড়ার সময় একটা ভয়ও কাজ করে, বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে খিচুড়িভাষায় কবিতা সংখ্যা হচ্ছে, অনেক সময় কবি সেগুলো না বুঝেই লিখছেন - যা পাঠক কানের জন্য সত্যি পীড়াদায়ক। মাসুমও তার কবিতায় সেই পথে হাঁটেন নি, আবার হেঁটেছেনও।

হাঁটার পথ চলে যখন চলে এলো তখন এটা স্পষ্ট করেই বলতে হয় কবিতার পথের শেষ নেই। চিত্রনাট্যের ভাজে ভাজে ছড়িয়ে থাকে নানারকম বাঁক, থাকে ঘাত ও প্রতিঘাত -- যা পাঠককে নিয়ে যায় এক অধ্যায় থেকে অন্য এক অধ্যায়ে। এক কবিতায় পাঠক পরিভ্রমণ করেন এক জায়গা থেকে অন্যকোনো জায়গায়। মাসুম তার কবিতায় দৃশ্যপট অংকনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। পাঠকের পাঠের পর একটা অদ্ভুত ভালোলাগা থাকে। অত্যাধুনিকতার মোড়কে মোটেও দুর্বোধ্যতার পথে যান নি। তিনি সরল মনে বলে গেলেন নিজের কথাগুলোকে। তেমনই একটি কবিতার গুটিকয় কিছু লাইন--
        "দিশেহারা পথিক,
         চেয়ে থাকে অপলক শূন্যে, মহাশূন্যে
         অতঃপর চোখের কোণে একফোঁটা জল
         এবং লাল মরীচিকা বাস।"
একটি না পাওয়ার বিজ্ঞাপন, মোহের বশে দৌড়ে চলা প্রতি মুহূর্ত। উড়ে বেড়ানো সময়ে ক্লান্ত হয়ে হাত পা ছোঁড়া আক্ষেপের আবেশে পুড়তে পুড়তে বুঝতে শেখা অসহায়ত্বের মায়াজাল। মাসুমের কবিতায় আমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক মনে হলো তার সহজবোধ্যতা আর গতিময় পঙক্তিমালা সেই সাথে কবিতার আবেগের ব্যবহার (যদিও এনিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা আছে) যা পাঠক এক মুহূর্তে দেয় এক অবিরাম ফল্গুপ্রবাহ।

বাঙালি স্যাটায়ার বোঝে না -- এই কথাটার সাথে আমি পুরোপুরি একমত। মুখবইয়ের দুনিয়ায় এমন ভুল বোঝাবুঝির অনেক নজির পাওয়া যাবে। স্যাটায়ারের প্রসঙ্গ নিয়ে বললাম "প্রতিবেশির অধিকার চাই" কবিতাটি পড়তে গিয়ে --
       "সীমান্তে অবাধ খুনের বৈধতা চাই
         চাই প্রতিবেশি আমাকে দেখভাল করুক
         আমার আকাশে প্রতিবেশির ঘুড়ি ওড়ানোর স্থান চাই
         এ-অধিকার মৌলিক, এই অধিকার মানতেই হবে।
        আমার পাহারাদার কুকুরগুলোকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিতেই হবে
         হাজার গুলিতে ঝাঁঝরা হলেও যেন রাইফেল অবনত রাখে
         মৃত্যুর আগেও যেন শেষ স্যালুট হয় প্রতিবেশির প্রতি"
মাসুমের অভ্যন্তরে জমে থাকা ক্ষোভকে নিংড়ে দিলেন, প্রতিবেশি কর্তৃক অন্যায় কে সরাসরি নয়, ঘুরিয়ে বললেন, তা বলতে কূটনৈতিক ভাষার আশ্রয় নেন নি, সাদামাটা ভাষাতেই বললেন তার যত অভিমানগুলোকে। বললেন পাহাড়াদার কুকুরদের প্রশিক্ষণ দিতে যাতে তাদের অস্ত্র সবসময়ের জন্য নিচু থাকে। প্রতিবেশির অধিকার চাইয়ের নামে একটা বিশেষ মহলের দিকে আঙুল তুলে দিয়ে বললেন নিজের অধিকারটুকু ছেড়ে দেয়ার কথা। তুলে ধরেছেন নিজেদের অসাবধানতায় বঞ্চিত হবার ইতিবৃত্ত। ভিতরের চূড়ান্ত ক্ষোভ কে উগড়ে দিয়েছেন মাসুম তার এমন কিছু কবিতায়। দেশ নিয়ে মাসুমের চিন্তাভাবনা সত্যি আশান্বিত করে তোলে আমাকে।

আবেগ নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। কবিতা মানেই শুধুমাত্র আবেগ নয়, অনেকসময় কবিকে আবেগের লাগাম টানতে হয় পাঠক কে কবিতার মাঝে একটা গন্তব্যে নিয়ে যাবার জন্য। আবেগের অতিরিক্ত ব্যবহার পাঠককে কবিতা থেকে ডিসকানেক্ট করে দেয়। মাসুমের কিছু কিছু কবিতায় আবেগের প্রবল ব্যবহার চোখে পড়লো, মনে হলো কবিতা কবির হাত থেকে ফস্কে বেরিয়ে এখন লাগামহীন হয়ে ছুটে যাচ্ছে সামনের দিকে। এইদিকটায় মাসুমকে আরো অনেক সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে কবিতাগুলোর পিছনে আরো বেশি সময় দিতে হবে। কবিতায় অতিরিক্ত আবেগের ব্যবহার দেখেই মনে হচ্ছিল কবি এখানে ভুলে গেছেন অপ্রয়োজনীয় শব্দ বিন্যাস কবিতাকে নড়বড়ে করে তোলে আর পাঠককে করে দেয় বিচ্ছিন্ন।

ছোটো কবিতার যে সাম্প্রতিক ট্রেন্ড তাকে মোটেও অস্বীকার করেন নি মাসুম মুনাওয়ার। তার বইতেও তিনি অনেক ছোটো কবিতা স্থান দিয়েছেন। তেমনই একটি ছোটো কবিতা 'ঋ'। চলুন ঋ কবিতাটা পড়ি।
     "রাত গভীর হলে স্বপ্ন ঘাড়ে চেপে বসে
      অতঃপর ঘামে ভেজা চাদরে হাত মোছে সকাল।"
দুটো লাইনের কবিতা, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় কিছুই নেই। কিন্তু কবিতার গভীরে যাদের চোখ, তারা ঠিকই বুঝে নিতে পারে এর কাব্যিক নির্যাস। তবে এমন কিছু ভালো কবিতার পাশাপাশি আরো কিছু কবিতা পড়ে মনে হলো কবিতাগুলো আরো শব্দ ডিম্যান্ড করে। চিত্রপট থাকে অথচ গভীরতা নেই। পাঠককে চমকে দেয়ার কোনো ম্যাসেজ নেই, ভালোলাগার মূর্ছনায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না কবিতাগুলো। ওই কবিতাগুলো পড়ে মনে হলো মাসুম এখনো প্রস্তুত নন এমন কবিতার জন্য। তার আরো সময় দেয়া উচিৎ এইধরনেএ কবিতার পিছনে।

কবিতা এক স্বতঃস্ফূর্ত সত্ত্বা, যেখানে কবি তার কলমের ছোঁয়ায় প্রাণ দেন কিছু শব্দমালাকে। কবিকে শব্দ প্রয়োগে হতে হয় প্রচণ্ড সচেতন, যাতে কবিতার মূল সুর, শব্দের ব্যঞ্জনা মোটেও ক্ষুণ্ণ না হয়। কবির বিন্দুমাত্র অসচেতনতা কবিতাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। শব্দগুলো আরোপিত মনে হতে পারে পাঠকের কানে। মাসুম তার কবিতায় কিছু অসতর্কের ছাপ রেখেছেন। কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রতিটি কবি তার কবিতাকে নিয়ে এইরকম পরীক্ষানিরীক্ষা করে থাকেন। মাসুমের "ঘর'' কবিতায় আঞ্চলিক ভাষা আর প্রথাগত ভাষার মেলবন্ধনে কবিতা লেখার প্রবণতা চোখে পড়লো। ঘর কবিতার চুম্বক অংশ এখানে শেয়ার করছি
     ''পূর্বে হয়তো বসবাস ছিলো কারো
       এখন শূন্য ফাঁকা ঘর। যাওয়া আসা ছিলো আমারো
       বড় সাধ জাগে ঘরের মালিক হওয়ার
       কিন্তু কী কপাল! ঘরে আমার খাড়ানোর কোনো জায়গা নেই
       ঘর আমারে জায়গা দেয় না তার ভিতর
       দূরে থাইক্যা টানে, কাছে গেলে চুপ হইয়া যায়
       আমার সাধ জাগে ঘরের ভিতর একটু ঘুমাই"
অস্বীকার করছি না, বর্তমানে অনেকে এইরূপ লিখছেন, নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করছেন। তারপরেও সেইসব শব্দমালাগুলো আমার কাছে আরোপিত বলে মনে হয়। কবিতা তার প্রাঞ্জলতা ছেড়ে ইট পাথর আর সিমেন্টের দালানের স্তূপাকৃতি নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। মাসুমের কবিতাটিতেও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

মাসুমের কবিতায় বিদেশী শব্দ ব্যবহারের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় দেখে অবাক লাগলো। জানি না কোনটা সঠিক অনিচ্ছাকৃত নাকি কবি এখনো এই দিকটায় নজর দেন নি, যেটাই ঠিক হোক না কেনো বিদেশী শব্দের নিপুণ ব্যবহার কবিতা কে নিয়ে নতুন এক উচ্চতায়, কবির দক্ষতাকে প্রমাণ করে সবার সামনে। আর কবিতার শব্দ ভাণ্ডার কে করে তোলে সমৃদ্ধ। কিন্তু এইপথে মাসুম একদমই হাঁটেন নি। এটা আমাকে খুব অবাক করেছে। নিজস্ব শব্দ তৈরির কথা এখনো অনেক দূরের কথা।

ভাবনার করিডোরে নতুন কোনো রসদ নাই বা দিলো সূর্যকুসুম, কিংবা সব কবিতা আপনার মনমতো হবে না সেটাও আপনি জানেন, তারপরও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই মাসুম তার লেখনীতে নতুন একটা শব্দস্বর তৈরিতে যে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন সেই পরিশ্রমটুকুকে। চিত্রপট তৈরিতে মাসুমের হাত যথেষ্ট পরিপক্ব। এর পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষায় পারদর্শিতা তার কলমকে দিয়েছে এক অনন্য শক্তি। আবেগকে ছেড়ে দিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলার প্রবণতা আর শব্দচয়নের প্রতি আরো গভীর মনোযোগ দিলে তার কবিতা হয়ে উঠবে আরো প্রাণবন্ত। পশ্চিমা কবিতার টোনের বাইরে এসে নিজস্ব একটা ঢং এর কবিতা উপহার দিয়েছেন সূর্যকুসুম বইতে। এই বইটা সাধারণ পাঠকের জন্য তৃপ্তিদায়ক। সূর্যকুসুম মাসুমের কাব্যপ্রতিভার ভূমিকা মাত্র। তার উপসংহারও মাসুমকে টানতে হবে। মাঝের যেই চর্চাক্ষেত্র তার প্রতি নিরলস খাটুনিতে সূর্যকুসুম মাসুমের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে বহুকাল। পাঠকদেরও কাব্যরসের নির্যাসটুকু জমতে থাকুক আগামীর কবিতার পথে।

লেখকঃ ইমেল নাঈম
              কবি

4 comments:

  1. নিচের কবিতা গুলো থেকে ভালো লাগার লাইন থাকলে আসলে ভালো লাগতো। ভেবে দেইখেন। জ্বালালাম আপনাকে।



    অমাবস্যার অন্ধকারে হারিয়ে গেলে গ্রাম
    জোনাকির আলোয় ছিঁড়ে যায় রাত্রির বাঁধন
    তখন পোকাদের সুরেলা সানাই-এ জেগে ওঠে মুখরিত বন
    ঝিঁঝিঁ পোকাদের চিৎকারে ভেঙে যায় ভবিষ্যতের সোনালি স্বপন।

    আর স্বপ্নহারা জাতি চলে অন্ধকার বন্ধুর পথ।



    দুই হাজার সাতদিন পর নির্জন বনে মিলিত হলে দুটি চড়–ইÑ
    বন জুড়ে নামে বৃষ্টিপাথর।
    পাখির কোলাহল ছেড়ে ঝিমোয় শহর
    শাদা গোলাপের খোঁজে কেউ যায় হিমালয় চূড়া;
    স্বপ্নেরা খুঁজে ফেরে কদাকার মানুষ।

    প্রতিবেশির অধিকার চাই!

    মুক্তি আমি চাই না, চাই প্রতিবেশির অধিকার
    ট্রানজিট-বন্দর-সীমান্তহাট
    চোরাচালানের ন্যায্য অধিকার চাই
    এই অধিকার মৌলিক, এই অধিকার ন্যায়ের
    আমার চিকিৎসা বন্ধ থাক, তবু আমি মানবতাবাদী
    প্রতিবেশির অধিকার চাই-ই চাই।

    সীমান্তে অবাধ খুনের বৈধতা চাই
    চাই প্রতিবেশি আমাকে দেখভাল করুক
    আমার আকাশে প্রতিবেশির ঘুড়ি ওড়ানোর স্থান চাই
    এ-অধিকার মৌলিক, এই অধিকার মানতেই হবে।
    আমার পাহারাদার কুকুরগুলোকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিতেই হবে
    হাজার গুলিতে ঝাঁঝরা হলেও যেন রাইফেল অবনত রাখে
    মৃত্যুর আগেও যেন শেষ স্যালুট হয় প্রতিবেশির প্রতি

    আমি চাই প্রতিবেশির প্রতি একান্ত ইবাদতের সুযোগ
    যাতে নিশ্চিন্ত হবে আমার ভবিষ্যৎ উন্নয়ন
    আমার এ-দাবি মানতেই হবে
    এ-দাবি মৌলিক

    সকল আশংকা দূর হোক
    নির্ভীক মনে সবাই মেনে নিক
    প্রতিবেশির অধিকার রক্ষার দাবি, মজলুম জনতার দাবি
    এ-দাবি মৌলিক দাবি
    এ-দাবি মানতেই হবে।

    [২০১০]

    সার্কাস

    কোকিলের কুহু কুহু ডাক
    মুকুলের সুঘ্রাণে জেগে ওঠে প্রাণ

    ফরমালিন দেয়া মিথ্যেগুলো
    তেলছটা রংয়ের মতো লেপ্টে থাকে
    প্রতিটি চরিত্রে
    আমি হয়ে উঠি সোনালি সার্কাস।

    বড় হওয়ার ভয়

    জীবন বড় কঠিন
    সময় চলে যায়; জীবনের অভিজ্ঞতা বাড়ে।
    আমার বয়স ঠায় পড়ে থাকে
    আমি শিশুর মত বেড়ে উঠি

    আমাকে স্পর্শ করে বড় হওয়ার ভয়
    আমি পৃথিবী দেখি শিশুর চোখে

    গিট্টু

    বুদ্ধি ও শরীরের মেদ বেড়েই চলেছে
    মেদ কমাতে দৌড়াই একশ মাইল
    ঘাম ঝড়াতে পারি না একফোঁটা
    বুদ্ধির মেদ জট পাকায় খুলতে গেলে
    আটকে যায়, জট থেকে গিট্টুতে রূপ নেয়
    আমি অসহায় হয়ে যাই তোমার পাশে

    সেকেন্ডে ঘেমে উঠি, মিনিটে গোসল
    ঘন্টায় সাঁতরাতে থাকি
    কাঁপা রোগ হয়, তুমি হাসো

    আমার পৃথিবী ছোট হয়ে আসে
    আলোতে অন্ধকার দেখি, অন্ধকারে অথৈ সাগর
    তুমি ফিক করে হেসে ওঠো
    লজ্জায় মরে যাই আমি, বুদ্ধির মেদ বাড়তে থাকে
    আমি আরো অসামাজিক হয়ে উঠি।

    আবরণ

    একটা আবরণ পরে আছি
    একটা খোলস লেগে আছে
    একটা ছদ্মবেশ ধরে আছি

    সকলেই
    একটা ছদ্মবেশ ধরে আছি

    সহজ স্বীকারোক্তি করা এখন অসম্ভব
    দারোগার বেয়নেটের থেকেও ধারালো প্রেমিকার কথা
    ছদ্মবেশই আমার একমাত্র উপায়

    প্রেমিকার বুকে হাত রাখলেও আমি সাধুবাবা


    আমার শেষ ঈশ্বর

    মুহূর্তেই বদলে গেলো আকাশের রঙ
    সোনালি আগুনে বদলে গেলো সবুজ গাঁ
    মানুষের গায়ের রঙ বদলে হলো নীল
    নীল আবরণে ঢেকে গেলো মানুষের তামাটে শরীর
    পরক্ষণেই বদলে গেলো পৃথিবী, শাদা মেঘ
    কিছুটা আকাশ পুড়ে গেলো
    খইয়ের মতো ছিটকে পড়লো সমস্ত তারা
    আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠলো চারকোণা মাঠ
    গিরিখাতে পোড়া আগুনে মহামূল্যবান রতœ
    জ্বলন্ত আগুনে জ্বল্জ্বল্ করছে একটুকরা নারী
    আমি নিবিড় ইবাদতে বসে আছি এক আজন্ম গোলাম
    জান্নাতুল ফেরদাউসের বদলে চাই তোমার মন
    কোটি বছরের ইবাদতের বদলে একটুকরা চুম্বন
    নিবিষ্ট গোলামের প্রার্থনা কবুল করো নারীÑ
    আমার শেষ ঈশ্বর

    স্বপ্ন

    দিনের আলো নিভে গেলে মেঘেরা ঘরে ফেরে
    পাখিরা সুর তোলে সবুজ কু-লীর ডগায়
    চাঁদ হামাগুড়ি দেয় বোবাদের শহর
    যোনিতে ঢুকে পড়ে পুরুষতান্ত্রিক সূর্য্য
    সামগ্রিক নোনাজল শুষে নেয় মাটি
    উর্বর জলে বেড়ে ওঠে সোনালি গোলাপ
    মাছেরা ভেসে বেড়ায় বায়ুম-লে; আর
    মাতৃতান্ত্রিক গৃহে বাস করে গৃহপালিত পুরুষ।

    যদি চলেই যাবে প্রিয়তমা তবে স্পর্শগুলো ফিরিয়ে দাও
    যদি চলেই যাবে প্রিয়তমা তবে চুম্বনগুলো ফিরিয়ে দাও।

    বিশ্বায়নের বাজারে শূন্যহাতে কী আর ব্যবসা চলে বল
    আমার সর্বস্ব উজার করা বিনিয়োগ আদরটুকু ফেরত না দিলে
    এই প্রতিযোগিতার বাজারে আমার কোনো পণ্যই যে কেনা হবে না!

    নষ্ট হয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলো আমার শেষ সম্বলÑ অন্তত ফিরিয়ে দাও।

    ভেঙে যাওয়া বাজারে পুঁজিপতিদের শেষ সারিতে দাঁড়াতে না পারলে
    কঙ্কালসার কোনো কাস্টমারও হাত ছাড়া হবে

    মিথ্যা ওয়াদাগুলোর বিনিময়ে যদি একটু সুখ মিলেÑ
    তাও এই শীত পার করে দেয়া যাবে হয়তো।

    যদি চলেই যাবে প্রিয়তমা তবে স্পর্শগুলো ফিরিয়ে দাও
    যদি চলেই যাবে প্রিয়তমা তবে চুম্বনগুলো ফিরিয়ে দাও।

    ক্রাশ

    কোনো কোনো চোখ শকুনের মত তাকিয়ে থাকে
    ছবি কথা বলে যায় হৃদয়ের গভীরে
    গোধুলি দিনভর ক্রাশ খেয়ে ছাতিমের ফুল
    আর আমার নাম ঢাকা পড়ে পতিত সন্ধ্যায়

    রাশিচক্রে মিলে যায় মন, সখি
    আমি প্রেমের কথা জুড়ে দেই বিশ্রামের সময়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ মাসুম। আপনার উপরে উল্লেখিত কবিতা গুলো পড়েছি। হুম এরমধ্যে কিছু কবিতা আমার খুব প্রিয়। চেয়েছি কম কথায় পুরোটা বইকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে। তাই হয়তো এই কবিতাগুলো ইচ্ছে সত্ত্বেও দিতে পারলাম না। :) বেশি বড় হলে পাঠক বোর হতে পারেন, সেটির দিকে নজর রাখাও একটা লক্ষ্য ছিলো।

      Delete
  2. লেখাটি ভালোই তবে আরো কিছু কবিতার উদাহারণ আসলে আরো সুন্দর দেখাতো।

    ReplyDelete